ওয়েব ডেস্ক: রাজধানীসহ সারাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার হ্রাস পেলেও জনমনে করোনা আতঙ্ক কাটছে না। গত কিছুদিন যাবৎ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। দৈনিক গড়ে নতুন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। করোনায় মৃতের সংখ্যাও ২৫ থেকে ৪০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে।
বৃহস্পতিবার (২০ মে) সর্বশেষ গত ২৪ ঘন্টায় ১৯ হাজার ৪৩৭টি নমুনা পরীক্ষা করে নতুন এক হাজার ৪৫৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। নমুনার সংখ্যার হিসেবে শনাক্তের হার সাত দশমিক ৫০ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। শতাংশের হিসেবে মৃত্যুহার এক দশমিক ৫৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৫ এপ্রিল থেকে চলমান লকডাউনসহ সরকারের নেয়া বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে এসেছে। তবে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঈদের আগে ও পরে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গ্রাম ও শহরমুখী লাখো মানুষের ঢল নিয়ে তারা চিন্তিত। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এর প্রতিফলন দেখা যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। এ ছাড়া সংখ্যায় কম হলেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীও শনাক্ত হয়েছে।
সরকার ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত সীমান্ত পথে কঠোর নজরদারি করছে। মাত্র তিনটি বর্ডার দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশে যাত্রী আসাযাওয়া করছে। ভারত থেকে ফেরা শনাক্তকৃত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে এবং তাদের সংস্পর্শে আসা সকলের প্রতি নজরদারি রাখা হচ্ছে। তবে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউ, আইসিইউ সমতুল্য এবং সাধারণ শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও হাইফ্লো নেজাল ক্যানুলাসহ চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম একাধিকবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, উন্নতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, কোনো দেশে অতিরিক্ত মাত্রায় রোগী সংক্রমিত হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় সকলকে আনা সম্ভব হয় না। এ কারণে সংক্রমণ হ্রাস করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলে মন্তব্য করেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো.নাজমুল ইসলাম নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বার বার দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে করোনার সংক্রমণ রোধে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রযোজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। দেশে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার চলমান কার্যক্রম আগামী দু/চারদিনের মধ্যে শেষ হচ্ছে (উল্লেখ্য, এখনও কমবেশি ১৭/১৮ লাখের দ্বিতীয় ডোজের টিকা বাকি রয়েছে)। তবে সরকার চীন, রাশিয়া ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যতদিন টিকা না পাওয়া যায় ততদিন টিকা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
তিনি বলেন, ‘ভারতীয়, ইউকে বা অন্য যে দেশের ভ্যারিয়েন্টই হোক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
যে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে
চলতি বছরের মার্চের শেষে রাজধানীনহ সারাদেশে করোনাভাইরাসের তীব্র সংক্রমণ ও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুসারে গত ৩১ মার্চ রাজধানীসহ সারাদেশে ২২৪টি সরকারি ও বেসরকারি করোনা টেস্ট ল্যাবরেটরিতে ২৬ হাজার ৬৭১টি নমুনা সংগ্রহ ও ২৬ হাজার ৯৩১টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫ হাজার ৩৫৮ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ৯০ অর্থাৎ ২০ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু হয় ৫২ জনের।
এপ্রিল মাসে রেকর্ডসংখ্যক একদিনে সর্বোচ্চ সাত হাজারেরও বেশি রোগী শনাক্ত হয়। মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে টানা কয়েকদিন করোনায় শতাধিক রোগীর মৃত্যু হয়। ১৬ থেকে ১৯ এপ্রিল যথাক্রমে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০১, ১০১, ১০২ এবং ১১২ জন।
সংক্রমণ বৃদ্ধির ওই সময়ে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালেগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে মুমূর্ষু করোনা রোগীকে আইসিইউ’র একটি শয্যায় ভর্তির জন্য অভিভাবক ও স্বজনরা পাগলের মতো রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি না হতে পেরে অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর লাগাম টেনে ধরতে লকডাউন দিতে বাধ্য হয় সরকার। গত ৫ এপ্রিল থেকে চলমান লকডাউন এখনও চলছে। প্রথম এক সপ্তাহ ঢিলেঢালা ও পরবর্তীতে ১৪ এপ্রিল (১ রমজান ও ১ বৈশাখ) থেকে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হয়। বিশেষ প্রয়োজনে পুলিশ মুভমেন্ট পাস ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার মতো কঠোর ও সর্বাত্মক লকডাউন চলে। সারাদেশে সকল ধরনের গণপরিবহন (বাস, লঞ্চ, বাস ও ট্রেন ও আকাশ পথে) চলাচল বন্ধ রাখা হয়। মার্কেট ও শপিং মল বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার স্বার্থে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেয়া হয়। মহানগরীতে গণপরিবহন চলাচল শুরু হলেও আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধই রাখা হয়। হাসপাতালে করোনা শয্যা বৃদ্ধি ও নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাব সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। নানা উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসে। তবে আবারও তা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ২০ মে পর্যন্ত দেশে সর্বমোট ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার ৮৮৩টি নমুনা পরীক্ষা করে সাত লাখ ৮৫ হাজার ১৯৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ২০ মে পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ২৮৪ জনের। মোট মৃতের মধ্যে পুরুষ ৮ হাজার ৮৮৪ জন ও নারী ৩ হাজার ৪০০ জন। সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে যথাক্রমে ৭ হাজার ৮৪ জন (৫৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ) ও ২ হাজার ৩১৪ জন (১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ)।
বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুসারে ৮১ শতাংশের মৃত্যু হয় ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের। সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে ৫৭ শতাংশের বেশি ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষের।